বংশগতি এবং কয়েকটি সাধারণ জিনগত রোগ
বংশগতি : বংশগতি হলো এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে জিনগত বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরের প্রক্রিয়া, যা পিতামাতা থেকে সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়. এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, জীবন্ত সত্তার দৈহিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায়. বংশগতির প্রধান উপাদান হলো ডিএনএ (DNA), যা ক্রোমোজোমের মধ্যে অবস্থিত.
বংশগতির মাধ্যমে, একটি প্রজাতির মধ্যে বৈচিত্র্য তৈরি হতে পারে এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা প্রজাতির বিবর্তন ঘটতে পারে. বংশগতিকে “হেরিডিটি” বা “উত্তরাধিকার” নামেও অভিহিত করা হয়.

জীবের বংশগতি ও বিবর্তন এবং জেনেটিক ডিসঅর্ডার জীবের বংশগতি ও বিবর্তন
পিতামাতার বৈশিষ্ট্যগুলো বংশানুক্রমে সন্তান সন্ততির দেহে সঞ্চারিত হওয়ার প্রক্রিয়াই হলো বংশগতি।
বংশগতিবস্তু
- ক্রোমোজোম
- ডিএনএ
- আরএনএ
- জিন
১. ক্রোমোজোম কাকে বলে
- দৈর্ঘ্য →3.5 থেকে 30.00 মাইক্রন (micron)
- প্রস্থ →0.2 থেকে 2.00 মাইক্রন (micron)
- মানবদেহে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে। এদের মধ্যে ২২ জোড়া অটোসোম (autosome)। ১ জোড়াসেক্স ক্রোমোজোম (sex chromosome)।

ক্রোমোজমের কাজ
- বংশগতির ধারক ও বাহক হিসাবে কাজ করে।
- বংশগতির ভৌত ভিত্তি হিসাবে কাজ করে।
- মানুষের চুলের রং, চামড়ার রং, চুলের প্রকৃতি, চোখের রং, চামড়ার গঠন নির্ধারণ করে।
২. ডিএনএ কী
- ক্রোমোজোমের প্রধান উপাদান হলো ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (deoxyribonucleic acid)।
- DNA দুই সূত্র বিশিষ্ট পলিনিউক্লিওটাইডের (polynucleotide) সর্পিলাকার গঠন (spiral structure)।
- একটি সূত্র অন্যটির পরিপূরক।

ডিএনএর উপাদান
- পাঁচ কার্বনযুক্ত শর্করা।
- নাইট্রোজেন বেস বা ক্ষার।
- অজৈব ফসফেট।
3. নিউক্লিওটাইড কী?
- পাঁচ কার্বনযুক্ত শর্করা, নাইট্রোজেন বেস বা ক্ষার এবং অজৈব
নাইট্রোজেন বেস বা ক্ষার | |
পিউরিন | পাইরিমিডিন |
এডিনিন (A) | সাইটোসিন (cytosine) (C) |
গুয়ানিন (guanine) (G) | থায়ামিন (thymine) (T) |
ফসফেটকে একত্রে নিউক্লিওটাইড বলে।
ডিএনএ বেস সংযুক্তি (Base attachment):
- একটি সূত্রের এডিনিন অন্য সূত্রের থায়ামিন (T) এর সাথে ২টি হাইড্রোজেন বন্ড দিয়ে যুক্ত থাকে। যেমন- A=T
- একটি সূত্রের গুয়ানিন অন্য সূত্রের সাইটোসিনের সাথে ৩টি হাইড্রোজেন বন্ড দিয়ে যুক্ত থাকে। যেমন- G≡C
- হেলিক্সের প্রতিটি পূর্ণ ঘূর্ণন 34Å দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট এবং একটি পূর্ণ ঘূর্ণনের মধ্যে ১০টি নিউক্লিওটাইড জোড়া থাকে।
- পার্শ্ববর্তী ২টি নিউক্লিওটাইডের দূরত্ব 3.4Å ।
১৯৫৩ সালে Watson এবং Crick প্রথম DNA অণুর ডাবল হেলিক্স বা দ্বি-সূত্রী কাঠামোর বর্ণনা দেন।
ডিএনএর কাজ (Work):
DNA ক্রোমোজোমের প্রধান উপাদান এবং বংশগতির রাসায়নিক ভিত্তি।
- প্রকৃত ধারক এবং বাহক, যা জীবের
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সরাসরি বহন করে
মাতা-পিতা থেকে তাদের বংশধরে নিয়ে যায়।
DNA অনুলিপন (DNA replication)
- এই প্রক্রিয়ায় একটি DNA অণু থেকে আরেকটি নতুন DNA অণু তৈরি হয় বা সংশ্লেষিত হয়।
- DNA অর্ধ রক্ষণশীল পদ্ধতিতে অনুলিপিত হয়।
- এই পদ্ধতিতে হাইড্রোজেন বন্ধন (hydrogen bond) ভেঙে গিয়ে DNA সূত্র দুটি আলাদা হয়ে যায়।
- প্রকৃত ধারক এবং বাহক, যা জীবের
DNA জীবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের
- তখন কোষের ভিতর ভাসমান নিউক্লিওটাইডগুলো থেকে A এর সাথে T, T এর সাথে A, C এর সাথে G এবং G এর সাথে C যুক্ত হয়ে সূত্র দু’টি তার পরিপূরক সূত্র তৈরি করে।
- DNA এর দু’টি সূত্রের ভেতর একটি পুরাতন সূত্র রয়ে যায় এবং তার সাথে একটি নতুন সূত্র যুক্ত হয়ে পরিপূর্ণ DNA অণুর সৃষ্টি হয়।
- অর্ধেক নতুন ও অর্ধেক পুরাতন নিয়ে গঠিত বলে একে অর্ধরক্ষণশীল পদ্ধতি বলে।

৩. আরএনএ কী? (What is RNA?):
- RNA হলো রাইবোনিউক্লিক এসিড (ribonucleic acid)।
- RNA-তে একটি পলিনিউক্লিওটাইডের (polynucleotide) সূত্র থাকে।
আরএনএর উপাদান (Matrials):
- পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট রাইবোজ সুগার
- নাইট্রোজেন বেস
- অজৈব ফসফেট
নাইট্রোজেন বেস বা ক্ষার পিউরিন পাইরিমিডিন
- এডিনিন (adinine) (A) 1. সাইটোসিন (cytosine) (C)
1. গুয়ানিন (guanine) (G) 1. থায়ামিন (thymine) (T)
আরএনএ বেস সংযুক্তি (Base attachment):
- A=U
- G≡C

জিন কী? (What is Gene?):
জীবের সব দৃশ্য এবং অদৃশ্যমান লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী এককের নাম জিন।
জিনের অবস্থান (location):
জীবের ক্রোমোজোমে।
৫. লোকাস কী? (What is Locus?):
ক্রোমোজোমের যে স্থানে জিন অবস্থান করে তাকে লোকাস বলে বা আরো স্পষ্টভাবে বললে ক্রোমোজোমের যে নির্দিষ্ট স্থানে যে নির্দিষ্ট জিন পাওয়া যায় ,ঐ স্থানটি উক্ত জিনটির লোকাস।

- জিন হচ্ছে বংশগতির নিয়ন্ত্রক।
- DNA→RNA→ প্রোটিন বৈশিষ্ট্য
- জিন দুই প্রকার। যথা:
- প্রকট জিন
- প্রচ্ছন্ন জিন
- গ্রেগর জোহান মেন্ডেলকে বংশগতিবিদ্যার জনক বলা হয়।
মেন্ডেলের পরীক্ষা (Mendel’s test):
T T= লম্বা হওয়ার জন্য দায়ী
t t= খাটো হওয়ার জন্য দায়ী

- সুতরাং, F1 ধাপে সবগুলো লম্বা হবে।
- প্রকট বৈশিষ্ট্য: প্রকট বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে বৈশিষ্ট্য যেটি প্রথম বংশধরে প্রকাশ পায়।
- প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য: যে বৈশিষ্ট্য প্রথম বংশধরে প্রকাশ পায় নাই কিন্তু ২য় বংশধরে 3:1 অনুপাতেপ্রকাশ পায় সেটি হচ্ছে প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য।
মানুষের লিঙ্গ নির্ধারণ (Determining human sex):
- মানবদেহে ক্রোমোজোম সংখ্যা ২৩ জোড়া।
- ২২ জোড়া হচ্ছে অটোসোম (autosome) এবং ১ জোড়া সেক্স ক্রোমোজোম (sex chromosome)।
- 44 অটোসোম + XY→ ছেলে

- নারীদের ডিপ্লয়েড কোষে (diploid cell) ২ টি সেক্স ক্রোমোজোমই x ক্রোমোজোম অর্থাৎ xx। কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে দুটির মধ্যে একটি x এবং অপরটি y ক্রোমোজোম অর্থাৎ xy।
- নারীদের ডিম্বাশয়ে ডিম্বাণু তৈরি করার সময় যখন মিয়োসিস বিভাজন ঘটে, তখন প্রতিটি ডিম্বাণু অন্যান্য ক্রোমোজোমের সাথে একটি করে x ক্রোমোজোম লাভ করে।
- অন্যদিকে পুরুষে শুক্রাণু সৃষ্টির সময় অর্ধেক সংখ্যক শুক্রাণু একটি করে x এবং বাকি অর্ধেক শুক্রাণু একটি করে y ক্রোমোজোম লাভ করে।
- ডিম্বাণু পুরুষের x ও y বহনকারী যেকোনো একটি শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত হতে পারে।
- গর্ভধারণকালে কোন ধরনের শুক্রাণু মাতার x বহনকারী ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয় তার উপর নির্ভর করে ভবিষ্যৎ সন্তানের লিঙ্গ।
জেনেটিক ডিসঅর্ডার (Genetic disorder)
(a) কালার ব্লাইন্ডনেস বা বর্ণান্ধতা (Color blindness)
- যখন কেউ কোনো রঙ সঠিকভাবে চিনতে পারে না, তখন তাকে কালার ব্লাইন্ডনেস বা বর্ণান্ধতা বলে।
- আমাদের জেনেটিক
ডিসঅর্ডারগুলো x ক্রোমোজোমের
কারণে ঘটে থাকে। - কালার ব্লাইন্ড অবস্থায়
রোগীদের চোখে স্নায়ুকোষের রং
শনাক্তকারী পিগমেন্টের অভাব থাকে। - যদি কারো একটি পিগমেন্ট না
থাকে তখন সে লাল আর সবুজ পার্থক্য করতে পারে না। - সাধারণত পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রতি ১০ জনে ১ জনকে কালার ব্লাইন্ড হতে দেখা যায়।

(b) থ্যালাসেমিয়া (Thalassemia)
- রক্তের লোহিত রক্ত কণিকার এক অস্বাভাবিক অভাবজনিত রোগের নাম থ্যালাসেমিয়া।
- থ্যালাসেমিয়া একটি অটোসোমাল রিসিসিভ ডিসঅর্ডার। অর্থাৎ, বাবা ও মা উভয়ই এ রোগের বাহক বা রোগী হলে তবেই তা সন্তানে
রোগলক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পায়।

লোহিত রক্তকোষ দুই ধরনের
প্রোটিন দিয়ে তৈরি। যথা-
- 1. α– গ্লোবিউলিন
- 2. β– গ্লোবিউলিন
α – থ্যালাসেমিয়া : যখন α-গ্লোবিউলিন তৈরির জিন অনুপস্থিত থাকে কিংবা ত্রুটিপূর্ণ থাকে তখন তাকে α-থ্যালাসেমিয়া বলে।
β – থ্যালাসেমিয়া : যখন β-গ্লোবিউলিন তৈরির জিন অনুপস্থিত বা ত্রুটিপূর্ণ থাকে তখন তাকে β-গ্লোবিউলিন বলে।